বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের (জবি) শিক্ষার্থীদের ওপর হামলার একটি ভিডিও ফেসবুকে ছড়িয়ে পড়েছে। এতে আন্দোলনকারীদের ওপর পিস্তলের গুলি ছুড়তে দেখা যায় ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের ৪৩ নম্বর ওয়ার্ড সাবেক কাউন্সিলর ও বাপুসের সাবেক সভাপতি আরিফ হোসেন ছোটন। এরপরে নতুন করে আলোচনায় আসেন তিনি।
দল বদলে আওয়ামী লীগে এসেছিলেন আরিফ হোসেন ছোটন। সাধারণ ক্ষমায় তার দণ্ডাদেশ মওকুফ করেছিলেন তৎকালীন রাষ্ট্রপতি বিচারপতি সাহাবুদ্দীন আহমদ। কিন্তু ক্ষমা পেয়েই পুরোনো চেহারায় দেখা দিয়েছেন তিনি।
আরিফ হোসেন সম্প্রতি ক্ষমতাচ্যুত হওয়া আওয়ামী লীগের ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের (ডিএসসিসি) ৪৩নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর এবং ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ছিলেন। পাশাপাশি তিনি বাংলাদেশ পুস্তক প্রকাশনা সমিতির সভাপতিও ছিলেন।
বাংলাবাজারের প্রকাশকদের ওপর অন্যায্য ও মনগড়া সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দেওয়া ও ১৬ বছর বিনা নির্বাচনে জোরপূর্বক বাংলাদেশ পুস্তক প্রকাশক ও বিক্রেতা সমিতির সভাপতির পদ দখলে রাখাসহ নানা অপরাধমূলক কাজ এবং কোটি কোটি টাকা আত্মসাতের অভিযোগ ছোটনের বিরুদ্ধে।
তথ্য সুত্রে জানা যায়, এরশাদের আমলে আলমগীর শিকদার লোটন যখন ছাত্রসমাজের কেন্দ্রীয় কমিটির সভাপতি, তখন ছোটনের ভাই সারোয়ার হোসেন টিটো ছিলেন সাধারণ সম্পাদক। তখন আরিফ হোসেন ছোটনকে ভোট ছাড়াই পুস্তক প্রকাশনা সমিতির ঢাকা মহানগর কমিটির সাধারণ সম্পাদক বানান লোটন ও টিটো। এ ঘটনায় শহিদ নামে একজন প্রতিবাদ করেন। কিছুদিন পরই আততায়ীর গুলিতে মারা যান তিনি। তখন প্রকাশকদের মুখে-মুখে এ খুনের ঘটনায় ছোটনের নাম আসে।
সময়ের পরিক্রমায় আরিফ হোসেন ছোটন ভোটারবিহীন এক নির্বাচনে পুস্তক প্রকাশনা সমিতির সভাপতি হন। সমিতির গঠনতন্ত্র অনুযায়ী ভোটের মাধ্যমে পরপর দুই দফায় সর্বোচ্চ চার বছর পদে থাকার বিধান থাকলেও তিনি সেটা মানেননি। এ নিয়ে কোনো প্রকাশক প্রতিবাদ করলে তার দোকানে তালা মেরে দেয় ছোটনের লোকজন। তার অনুসারীদের অত্যাচারের কারণে একুশে প্রকাশনীর মিজানসহ বেশ কয়েকজন বাংলাবাজার ছাড়তে বাধ্য হয়েছেন। এ ছাড়া প্রকাশকদের তার কাছ থেকে কাগজ কিনতে বাধ্য করারও অভিযোগও আছে তার বিরুদ্ধে।
বাংলাদেশ পুস্তক প্রকাশক ও বিক্রেতা সমিতির সভাপতির নাম ভাঙিয়ে আরিফ হোসেন ছোটন বাড়ি ও মার্কেট দখল, চাঁদাবাজি, মাদক ব্যবসা, হেরিটেজখ্যাত লালকুঠির জায়গায় অবৈধ দোকান নির্মাণ করেন। কুঠির জায়গায় বেশ কয়েকটি দোকান বানিয়ে ভাড়া দেন ছোটন। এলাকাবাসীর অভিযোগ, এসব দোকানের পজিশন বিক্রি করে কয়েক কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন তিনি।
বাংলাবাজার এলাকার চাঁদাবাজ সবাই আরিফ হোসেন ছোটনের অনুসারী। বাদামতলী ঘাট থেকে ওয়াইজঘাট পর্যন্ত এলাকায় তারা চাঁদাবাজির সঙ্গে জড়িত। সদরঘাট এলাকায় চাঁদাবাজি করে খলিফা বাহিনী। অনুসারী চাঁদাবাজদের কাজ হলো- পুস্তক ব্যবসায়ীদের চাপ দেওয়া ও জোরপূর্বক মাসিক চাঁদা আদায় করা। চাপের মুখে শ্যামবাজার ব্যবসায়ী বণিক সমিতিকে প্রতিদিন ৭৫ হাজার টাকা দিতে হতো ছোটনকে। এমনকি শ্যামবাজার পাইকারি মার্কেটে যত ট্রাক পণ্য যায়, প্রতি ট্রাকে দেড় হাজার টাকা চাঁদা দিতে হয়। বাদ যায়নি বাংলাবাজারের পান ব্যবসায়ীরাও। তাদের কাছ থেকেও গাড়িপ্রতি ৫০০ টাকা ও ভ্যানপ্রতি ১৫০ টাকা চাঁদা তুললো ছোটনের অনুসারী চাঁদাবাজরা।
২৫, পিসি ব্যানার্জি লেনের এক বাড়িওয়ালাকে কয়েক বছর বাড়িতে ঢুকতে দেননি ছোটন। পরে সাত কাঠা ভূমির ওপর আনুমানিক পাঁচ কোটি টাকা মূল্যের পাশাপাশি ওই দুটি বাড়ি কেনেন মাত্র ৪০ লাখ টাকায়। সেখানে বহুতল ভবন তুলেন ছোটন। ২২ নম্বর পাতলা খান লেনে ছোটনদের ছিল পুরনো বাড়ি। বাড়ির পেছনে কিছু সরকারি প্যাসেজ ছিল। বাপুস সভাপতি হয়ে সেখানে ১০ তলা অত্যাধুনিক ভবন তৈরি করেছেন ছোটন। বাড়ি তৈরির সময় দখল করে নিয়েছেন প্যাসেজটি। এ ছাড়া ১৬, কেজি গুপ্ত লেনে একটি মন্দিরের জায়গা দখল করে জেনারেটর ব্যবসা করছেন বলেও অভিযোগ রয়েছে ছোটনের বিরুদ্ধে।
সদরঘাট এলাকায় বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলন চলাকালীন রিক্সাচালক রিপন হত্যায় রাজধানীর কোতয়ালি থানায় মামলাসহ ২০টির অধিক মামলা দায়ের করা হয়েছে আরিফ হোসেন ছোটনের বিরুদ্ধে ।
উল্লেখ্য, ছাত্রসমাজের ঢাকা মহানগর দক্ষিণের সাধারণ সম্পাদক থাকার সময় নর্থব্রুক হল রোডে একজন মোটর পার্টস ব্যবসায়ীর কাছ থেকে চাঁদাবাজির ঘটনায় গোলাগুলি হয়। তখন একজন এএসপিসহ তিনজন গুলিবিদ্ধ হন। এ ঘটনায় ছোটনসহ ছয়জন গ্রেপ্তার হন। মামলায় ছোটনকে সাত বছর কারাদণ্ড দেন আদালত।
১৯৯১ থেকে ১৯৯৬ সাল নাগাদ ছোটনের বিরুদ্ধে খুন-অস্ত্রবাজি-সন্ত্রাস-চাঁদাবাজিসহ বিভিন্ন অভিযোগের ৩২টি মামলা ছিল। কিন্তু ১৯৯৪ সালের দিকে তিনি আওয়ামী লীগে যোগ দেন। ১৯৯৬ সালের ১২ জুনে জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর আওয়ামী লীগ সরকার গঠন করে। এর পর তার সব মামলা একে একে প্রত্যাহার হয়ে যায়। তৎকালীন রাষ্ট্রপতি বিচারপতি সাহাবুদ্দীন আহমদের সাধারণ ক্ষমার আওতায় মওকুফ হয় সাত বছরের দণ্ডাদেশ।
Posted ১২:০৬ অপরাহ্ণ | বুধবার, ০৪ সেপ্টেম্বর ২০২৪
Sangbad Dinrat | Editor & Publisher