আন্তর্জাতিক অভিবাসী দিবস উপলক্ষে প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ ইউনুস বরাবর খোলা চিঠি লিখেছেন বিটিইএ’র চেয়ারম্যান শহিদুল ইসলাম সাগর।
মঙ্গলবার (১৭ ডিসেম্বর) রাতে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে দেওয়া এক স্ট্যাটাসে তিনি এ চিঠি প্রকাশ করেছেন।
চিঠিতে বিটিইএ’র চেয়ারম্যান লিখেন; বিশ্বব্যাপী শ্রম সংকট একটি বৈশ্বিক বাস্তবতা, যা বিভিন্ন খাত এবং অঞ্চলের জন্য একটি গুরুতপুর্ন চ্যালেঞ্জ। আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার (ILO) এর ২০২৪ সালের তথ্য মতে, আগামী ২০৩০ সালের মধ্যে বিশ্বজুড়ে প্রায় ৮৫ মিলিয়ন শ্রমিকের ঘাটতি তৈরি হবে। বিশেষ করে স্বাস্থ্যসেবা, প্রযুক্তি, নির্মাণ, উৎপাদন এবং পর্যটন খাতে এই ঘাটতি সর্বাধিক। যদি উপযুক্ত পদক্ষেপ না নেওয়া হয়, আগামী বছরগুলিতে এই ঘাটতি আরও বৃদ্ধি পেতে পারে।
শ্রম সংকটের কিছু কারণসমুহ উল্লেখ করে তিনি লিখেন-
ক) বৃদ্ধ জনসংখ্যা: উন্নত দেশগুলোতে বৃদ্ধ জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার বেড়েছে, যার ফলে কর্মক্ষম মানুষের সংখ্যা কমে যাচ্ছে।
খ) দক্ষতার ঘাটতি: প্রযুক্তির দ্রুত উন্নতি হওয়ায় দক্ষ শ্রমিকের চাহিদা মেটানো যাচ্ছে না, দিন দিন তা তিব্র আকার ধারণ করছে।
গ) মহামারি পরবর্তী পরিবর্তন: কোভিড-১৯-এর পর সারাবিশ্বে শ্রমিকের সংকট আরও বেশী তীব্রতর হয়েছে যা সামাল দিতে উন্নত দেশ গুলো হিমশিম খাচ্ছে।
বিশ্বের যেসব খাতে শ্রমিকের চাহিদা সবচেয়ে বেশি তা হলো-
১. স্বাস্থ্যখাত:
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (WHO) তথ্যমতে, বিশ্বব্যাপী ১৫ মিলিয়ন স্বাস্থ্যকর্মীর অভাব রয়েছে।
ক) সাব-সাহারান আফ্রিকা: প্রতি ১০,০০০ জনে মাত্র ৩ জন স্বাস্থ্যকর্মী রয়েছেন।
খ) উন্নত দেশ: যুক্তরাষ্ট্র, জাপান, এবং ইউরোপে বৃদ্ধ জনসংখ্যার কারণে গেরিয়াট্রিক নার্স ও বিশেষজ্ঞদের চাহিদা বেড়েছে।
গ) মধ্যেপ্রাচ্য: বিভিন্ন দেশে বয়স্কদের সেবা ও নার্সিং এর জন্য ব্যাপকভাবে কেয়ার গিভার এর চাহিদা বেড়েছে।
২. প্রযুক্তি খাত: ডিজিটাল রূপান্তর এবং AI, ব্লকচেইন ও সাইবার সিকিউরিটির মতো প্রযুক্তির চাহিদা বেড়েছে। বিশ্বব্যাপী ৪.৩ মিলিয়ন দক্ষ IT কর্মীর অভাব রয়েছে।
৩. নির্মাণ খাত: বিশ্বব্যাপী ৫ মিলিয়ন শ্রমিকের অভাব রয়েছে, বিশেষত উন্নত অর্থনীতিতে।
৪. উৎপাদন খাত: বৈশ্বিক উৎপাদন প্রক্রিয়া চালাতে ১০ মিলিয়ন দক্ষ শ্রমিকের অভাব রয়েছে।
৫. পর্যটন খাত: বিশ্ব পর্যটন সংস্থা (UNWTO) অনুযায়ী, ২০১৯ সালে পর্যটন খাতে ৩৩ কোটি মানুষের কর্মসংস্থান হয়েছিল, যা বৈশ্বিক কর্মসংস্থানের প্রায় ৯ শতাংশ। বিশ্বব্যাপী এই খাতে শ্রমিক সংকটের পরিমাণ সম্পর্কে আন্তর্জাতিক পর্যটন সংস্থা (UNWTO) এবং অন্যান্য গবেষণা প্রতিষ্ঠানগুলোর তথ্য অনুসারে, শুধু মাত্র ইউরোপ, যুক্তরাষ্ট্র এবং কানাডার মতো দেশে পর্যটন খাতে প্রায় ১.৯ মিলিয়ন শ্রমিকের অভাব রয়েছে।
দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া (যেমন থাইল্যান্ড, মালয়েশিয়া), লাতিন আমেরিকায় (যেমন ব্রাজিল, মেক্সিকো), ভারত-চীন সহ অন্যান্য দেশে পর্যটন খাতে শ্রমিকের অভাব রয়েছে। যেমন- হোটেল কর্মী, রেস্তোরাঁ কর্মী, গাইড, ট্রাভেল এজেন্ট, লজিস্টিকস কর্মী এবং অন্যান্য পর্যটন সংশ্লিষ্ট পেশায় শ্রমিকের সংকট তীব্র থেকে তীব্রতর হচ্ছে।
বিশ্বে সবচেয়ে বেশী শ্রমিকের চাহিদা যেসব আঞ্চলে রয়েছে তা হলো-
উত্তর আমেরিকা:
ক) যুক্তরাষ্ট্রে ১.১ কোটি খালি পদ রয়েছে।
* স্বাস্থ্যসেবায় ২.১ মিলিয়ন এবং খুচরা খাতে ১.৫ মিলিয়ন কর্মীর অভাব।
খ) কানাডায় ১ মিলিয়ন খালি পদ, বিশেষত স্বাস্থ্যসেবা ও নির্মাণ খাতে।
ইউরোপ:
ক) ইউরোপ সেনজেন ও নন সেনজেন বিভিন্ন দেশে শ্রমিক ঘাটতি ১২ মিলিয়ন, যার মধ্যে ৩.৫ মিলিয়ন স্বাস্থ্যকর্মী এবং ২.৪ মিলিয়ন কৃষি শ্রমিকের অভাব। শুধু জার্মানিতেই ২০ লাখ দক্ষ কর্মীর ঘাটতি রয়েছে।
খ) ইউক্রেন রাশিয়া যুদ্ধের কারনে ইউক্রেনে যে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে তার পুনঃনির্মানের জন্য প্রায় ১৫ লক্ষ শ্রমিক সংকট হয়েছে।
ইউরেশীয়া:
রাশিয়া, জর্জিয়া, আর্মেনিয়া, বেলারুশ ও কিরগিজস্থানে প্রায় ২৫ লক্ষ দক্ষ শ্রমিকের সংকট সৃষ্টি হয়েছে, কারন দেশগুলো অতিসম্প্রতি ব্যাপক শিল্পায়নের প্রসার ঘটিয়েছে।
এশিয়া:
ক) চীনের উচ্চ-প্রযুক্তি শিল্পে পরিবর্তন আসায় উৎপাদন খাতে ৬ মিলিয়ন দক্ষ শ্রমিকের অভাব দেখা দিয়েছে।
খ) জাপানে ৪ মিলিয়ন খালি পদ রয়েছে, যার মধ্যে ২ মিলিয়ন স্বাস্থ্যকর্মী প্রয়োজন।
গ) দক্ষিণ কোরিয়ায় ১.৮ মিলিয়ন কর্মীর অভাব।
মধ্যপ্রাচ্য:
ক) সংযুক্ত আরব আমিরাতে (UAE) নির্মাণ এবং স্বাস্থ্যখাতে প্রায় ১৫ লক্ষ, সৌদি আরবে নির্মাণ, খনন, কৃষি ও স্বাস্থ্যখাতে প্রায় ২৫ লক্ষ ৫০ হাজার দক্ষ শ্রমিকের শ্রমিকের ঘাটতি রয়েছে।
খ) কাতারে নির্মাণ খাতে ৬ লক্ষ, কুয়েতে নির্মাণ, কৃষি, এবং পরিষেবা খাতে ৩ লক্ষ, ওমানে নির্মাণ ও কৃষি খাতে প্রায় ২ লক্ষ ৫০ হাজার দক্ষ শ্রমিকের অভাব রয়েছে।
অস্ট্রেলিয়া :
স্বাস্থ্যসেবা খাতে প্রায় ৫ লক্ষ, নির্মাণ খাতে ১ লক্ষ, কৃষি খাতে প্রায় ৩ লক্ষ, প্রযুক্তি খাতে প্রায় ১ লক্ষ, পর্যটন খাতে প্রায় ৫০ হাজার কর্মীর অভাব রয়েছে।
আফ্রিকা:
ক) সাব-সাহারান আফ্রিকায় ৪.৩ মিলিয়ন স্বাস্থ্যকর্মীর অভাব।
খ) কৃষি ও খনিতে ২ মিলিয়ন শ্রমিক প্রয়োজন।
ল্যাটিন আমেরিকা
ব্রাজিলে ২.৫ মিলিয়ন শ্রমিক এবং মেক্সিকোতে ১.২ মিলিয়ন শ্রমিকের ঘাটতি রয়েছে।
উন্নত বিশ্ব শ্রমিক সংগ্রহ করবে কোথা থেকে-
এবার আসেন দেখি সব মিলিয়ে ৮৫ মিলিয়ন শ্রমিক সংকট মোটাবেলা করতে কোন কোন দেশের দিকে নজর দিবে।
১) ল্যাটিন আমেরিকার দেশগুলোর দিকে।
২) আফ্রিকার দরিদ্রতম দেশ গুলো থেকে।
৩) দক্ষিণ এশিয়ার দেশ গুলো থেকে।
বাংলাদেশের বাস্তবতা ও সুযোগ:
বাংলাদেশে বর্তমানে বেকারত্বের হার প্রায় ৪% হলেও ৪.২ মিলিয়ন তরুণ বেকার রয়েছে। এবং প্রতিবছর গড়ে ২২ লক্ষ যুবক-যুবতি কর্মক্ষম হয়ে শ্রমবাজারে আসছে। দেশের অভ্যান্তরে কর্মসংস্থান হচ্ছে সরকারি বেসরকারি মিলে ৫/৬ লক্ষ যুবক-যুবতির, বাকি প্রায় ১৫-১৬ লক্ষ যুবক-যুবতিকে বেকারত্ব বরন করতে হচ্ছে। আমাদের এই বিশাল যুবসমাজ বিশ্বব্যাপী শ্রম সংকট মোকাবিলায় একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে।
বাংলাদেশের করণীয় ও পদক্ষেপ:
১) কারিগরি দক্ষতা উন্নয়ন
ক) সরকার ও বেসরকারি খাত মিলে কারিগরি প্রশিক্ষণ কেন্দ্র স্থাপন করতে হবে।
খ) স্বাস্থ্যসেবা ও প্রযুক্তি খাতে বিশেষায়িত প্রশিক্ষণ চালু করতে হবে।
গ) বিশ্বমানের প্রশিক্ষণ নিশ্চিত করতে বিদেশি প্রতিষ্ঠানগুলোর সঙ্গে অংশীদারিত্ব গড়ে তোলা।
২) ভাষাগত দক্ষতা বৃদ্ধি: ইংরেজি ও অন্যান্য প্রয়োজনীয় ভাষা যেমন জার্মান, জাপানি, চাইনিজ, রাশিয়ান শেখার ব্যবস্থা করতে হবে।
৩) বিশ্ব শ্রমবাজারে প্রবেশের উদ্যোগ নেওয়া দরকার জরুরি:
ক) শ্রম ঘাটতির দেশগুলোর সঙ্গে দ্বিপাক্ষিক চুক্তি করে বাংলাদেশি কর্মীদের নিয়োগের সুযোগ তৈরি করতে হবে।
খ) বিদেশে কাজের জন্য ভিসা প্রক্রিয়া সহজ করতে হবে এবং রিক্রুটিং এজেন্সি গুলো সহ আন্তর্জাতিক অঙ্গনের সাথে যুক্ত বাংলাদেশী ওভারসীস পার্টনার গুলোকে সাথে নিয়ে উপযুক্ত পরিকল্পনা গড়ে তুলতে হবে।
গ) ইউরোপ মহাদেশীয় সেনজেন ও নন সেনজেন সকল দেশের গুলোর দুতাবাস বা ভিসা সেন্টার বাংলাদেশে দ্রুত চালুর ব্যবস্থা করতে হবে।
৪) পর্যাপ্ত তথ্যভান্ডার ও প্ল্যাটফর্ম গড়ে তোলা:
ক) জাতীয় শ্রম শক্তি ডাটাবেজ তৈরি করে দক্ষ যুবকদের তালিকা প্রস্তুত করা।
খ) দক্ষ কর্মীদের বিদেশে পাঠাতে বিশেষ প্লেসমেন্ট এজেন্সি গড়ে তোলা।
৫) সফল বাস্তবায়নের মাধ্যমে দেশের উন্নয়ন:
ক) বিদেশে কর্মরত শ্রমিকদের রেমিট্যান্স দেশের অর্থনীতিকে শক্তিশালী করবে।
খ) দক্ষতা অর্জন শেষে বিদেশফেরত কর্মীদের অভিজ্ঞতা কাজে লাগিয়ে দেশের উৎপাদনশীলতা বাড়ানো যাবে।
গ) শ্রীলঙ্কা দেউলিয়া অর্থনীতি পুনরুদ্ধারে যেকোন মুল্য বিদেশে শ্রমিক রপ্তানি ও পর্যটন আকর্ষণের কৌশলকে উদাহরণ হিসাবে গ্রহণ করতে হবে।
তিনি আরও লিখেছেন, বাংলাদেশের বিশাল যুবসমাজ এবং বিশ্বব্যাপী শ্রম সংকটের বাস্তবতা আমাদের জন্য একটি সুবর্ণ সুযোগ। যদি আপনার অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয় যথাযথ পরিকল্পনা নিয়ে দক্ষতা উন্নয়ন, ভাষা শিক্ষা এবং বিশ্ব শ্রমবাজারে প্রবেশের দ্রুত উদ্যোগ নেন , তাহলে এটি শুধু আমাদের বেকারত্ব হ্রাস করবে না বরং রেমিট্যান্স বৃদ্ধির মাধ্যমে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিকে ত্বরান্বিত করবে। এখানে আমাদের সবচেয়ে বড় সম্পদ হলো যুব শক্তি। তাই এই শক্তিকে দক্ষ করে গড়ে তুলতে সমন্বিত প্রয়াস, সরকারি-বেসরকারি অংশীদারিত্ব এবং বৈশ্বিক সহযোগিতা অপরিহার্য।
বিটিইএ’র চেয়ারম্যান সাগর প্রধান উপদেষ্টাকে ধন্যবাদ দিয়ে লিখেন, আপনি বিশ্বব্যাপী সর্বজনবিদিত একজন নোবেল লরিয়েট। ইউরোপ, আমেরিকা, অস্ট্রেলিয়া, আফ্রিকা, এশিয়ার উন্নত দেশগুলোর রাস্ট্র প্রধান আপনাকে সজ্জন মানুষ হিসাবে জানে। আপনি যদি উপরে উল্লেখিত লেখাগুলোর গুরুত্ব অনুধাবন করে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়কে দিকনির্দেশনা সম্বলিত আদেশ দেন তাহলে বাংলাদেশের অর্থনীতির বৈপ্লবিক পরিবর্তনে পাশাপাশি দেশবাসী উপকৃত হবে। ধন্যবাদ।
লেখক- শহিদুল ইসলাম সাগর
চেয়ারম্যান, বিটিইএ
জনশক্তি রপ্তানি ও পর্যটন কর্মী
Posted ৮:০৯ অপরাহ্ণ | বুধবার, ১৮ ডিসেম্বর ২০২৪
Sangbad Dinrat | Editor & Publisher